মাটির ওপর আমেনা ইচ্ছা করেই একটু কাছে ঘেঁষে বসে। বসার পরে নিজের পা পিছলে আনে—যেন সারা গায়ে পুরোনো কাপড়, কাদামাখা চট আর পলিথিনে প্যাঁচানো শরীরটার সঙ্গে তার ঊরুর ছোঁয়া লাগে। ছোঁয়া লাগতেই চমকে ওঠে, যা ভেবেছিল তা-ই। নিশ্চিত হতে গালে হাত ছোঁয়ায়, শরীরটা ঠান্ডা তো বটেই; কিছুটা শক্তও হতে শুরু করেছে।
ভোরবেলা লোকটাকে ঠিকঠাকই দেখেছিল। খানিক হামাগুড়ি দিয়ে আর খানিক গড়িয়ে সে ফার্মগেটের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে ফুটপাতের ওই কোণে এসে থেমেছিল। আমেনাকে ওই লোকের আগে আসতে হয়। গত ঈদের সময় গ্রাম থেকে ধরে আনা নতুন কিছু ছেলেমেয়েকে কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কয়েকটা জায়গায় বসিয়ে দেওয়া তার কাজ। সারা দিন ভিক্ষা করিয়ে দিন শেষে তাদের কাছে ভালোই টাকা পাওয়া যায়। তবে সমস্যা হলো, কয়েক দিনেই কুত্তার বাচ্চাদের চোখ ফুটে যায়। অন্য কোথাও গিয়ে বসে আর আমেনার হিস্যাটা না দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। ছোট ছেলেগুলো নিয়ে আরেক সমস্যা, কয়েক দিনেই গাম শোঁকা ধরে ফেলে। তারপর কোথায় পড়ে থাকে কে জানে! কাজে মন নেই দেখলে আমেনার গা জ্বালা করে, দেয় লাগিয়ে কয়েকটা চটকনা।
আমেনা চোরা চোখে পড়ে থাকা লোকটার দিকে তাকায়। ভোরের পরপর তেজগাঁর দিক থেকে রিকশা থেকে নেমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে লোকটা আসে। হাত দুটোই সম্বল তার, পা হাঁটুর ওপর থেকে কাটা। কাটা অংশে নীল পলিথিন প্যাঁচানো। আমেনার মতো সুস্থ–সবল শরীরে, তাও আবার কিছুটা মেদবহুল হলে মানুষে ভিক্ষা দিতে চায় না। উষ্কখুষ্ক চুল আর কাঁচাপাকা দাড়ির অর্ধেক শরীরঅলা লোকটাকে তাই আমেনার শুরু থেকেই হিংসা। এর কাছেধারে বসে লাভ নেই, মানুষ আমেনাকে না দিয়ে ওকেই দেবে। তাই ব্রিজের সিঁড়ির নিচের জায়গাটার দখল কোনো দিন আগেভাগে নিলেও ওই লোক এসে বসলেই কেল্লা ফতে। আমেনাকে তখন সরে যেতে হয়। চোখাচোখি হলে লোকটা নির্লিপ্তভাবে তাকিয়েই চোখ বুজে ফেলে। কচ্ছপের মতো পলিথিন আর চটের ঘেরাটোপের নিচে আধা শরীরটা রেখে মাথাটা একদিকে কাত করে রাখে।
তবু কৌতূহলের বশে কোনো দিন সেখানে কিছুক্ষণ বসে আমেনা। লোকটা মাথা না উঠিয়েই কিছু পরপর হাতটা ওঠায়, পথচারী তাতেই পাঁচ-দশ টাকা মেলামাইনের থালার ওপর রাখে। একদিন বসে থাকতে থাকতে আমেনা দেখে এক ভদ্র ঘরের বউ, ইস্ত্রি করা পরিষ্কার ছাপা শাড়ি গায়ে, ঝুঁকে কথা বলছে কচ্ছপের কানের কাছে মুখ নিয়ে। ও রকম এক ভদ্রমহিলার কী কথা থাকতে পারে রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া ওই আধব্যাটারির সঙ্গে? শালার রাস্তার শব্দে কিছু শোনারও উপায় নেই! আমেনা একটা কাগজ কুড়ানোর ছলে সিঁড়ি ঘেঁষে বসে। তারপর কথা শুনে সে তাজ্জব! ফিটফাট মহিলাটা আর কেউ নয়, কচ্ছপের বউ!
মনে মনে আমেনা ভাবে, ওইদিকে চুপে চুপে হয়তো বড়লোকি আছে সংসারে আর এদিকে লোকটা রোদে-কাদায়-বৃষ্টিতে পড়ে পড়ে ভেজে আর শুকায়। যাক, যার যা রুচি, আমেনার কী? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে এ-ও প্রশ্ন আসে, তাহলে কি এই লাইনে থাকতে থাকতে একদিন আমেনারও ও রকম পরিষ্কার ছাপা শাড়ি পরে সচ্ছল একটা সংসার করার মুরোদ হবে? ভাবতেই চোখে প্রায় পানি এসে যায়। ও রকম সংসার সে কাছে থেকে দেখেছে। ঢাকায় প্রথম এসে ও রকম কয়েকটা বাড়িতে পরপর কাজ করেছে। তবে পোষায়নি। তার হলো গিয়ে নেতাস্বভাব, মানুষের রান্নাঘরে ও রকম মিউ মিউ করলে দিন চলবে?
মৃত লোকটার দাড়িওয়ালা গালটার ওপর হাত ছোঁয়ানোর পরপরই আমেনার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। এখনো ভালোমতো দুপুর হয়নি। লোকটার পরিষ্কার আর বড়লোক ওই বউ এলেও আসতে পারে সন্ধ্যা নাগাদ। এদিকে সে মরে পড়ে আছে। রাস্তার লোকে টের পেলে পুলিশে খবর দিতে পারে। তাদের কেউ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে বেসরকারি হাসপাতালে ওকে বেচে দিতে পারে। কিংবা যেখানে রাখবে সেখানে আত্মীয় সাজিয়ে কাউকে আনবে, তারপর লাশ বুঝে নিয়ে জ্বাল দিয়ে হাড়গোড় বের করে বিক্রি করতে পারে ডাক্তারি পড়া ছেলেমেয়েদের কাছে। আমেনা কি এখন সেই প্রথম ঢাকায় পা দেওয়ার সময়কার মতো বোকাসোকা আছে? এই সব আঁটঘাট এখন সব তার মুখস্থ।
মোড়ের কাছে ট্রাফিক পুলিশ ঘোরাফেরা করে। তাদের কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে লোকটা মরে পড়ে আছে। ভাবতে ভাবতেই আমেনা মনে মনে হাসে, কেউ এখনো বুঝতেও পারেনি, টুসটাস দুই কি পাঁচ টাকার পয়সা থালায় পড়ছে। আমেনা একছুটে কোত্থেকে যেন একটা ময়লাটে সাদা কাপড় আনে। তারপর কচ্ছপের গায়ের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে আন্দাজে তার পিঠের ওপর হাত বুলায়। নিজের রংজ্বলা শাড়ির আঁচলটাও টেনে ছড়ায় পিঠটায়। গুনগুনিয়ে কান্নার দমকটা কেমন যেন হাত বোলানোর হাত ধরেই আসে।
ধীরে ধীরে পয়সার ঝনঝনানি বন্ধ হয়ে নিঃশব্দে কাগজের টাকা পড়তে থাকে। কেউ কেউ থালার বদলে কাফনের মতো সাদা কাপড়টার ওপরই টাকা রাখে। আমেনা তা–ই দেখে সেখানেও কিছু পয়সা ছড়িয়ে রাখে। মাঝেমধ্যে এদিক–ওদিকে টেনে বাতাসে ওড়া কিঞ্চিৎ ছোট কাপড়টাকে জায়গামতো মেলে। এই সব করতে করতে গুনগুনানো কান্নাটা ফোঁপানিতে উঠে যায়। কেউ বিশ–ত্রিশ টাকা দিলে সেটা পৌঁছায় ডুকরে কাঁদায়…‘ওরে আমার ছাওয়ালের বাপ, তুমি কই গেলা গো…আমারে একলা কইরা চইলা গেলা তুমি…আমি এখন কী কইরা খামু, তোমারে মাটি দেওনের ট্যাকা কই পামু, কাফনের কাপড় কে কিন্যা দিব আমারে…বাপ হইয়া তুমি পোলা দুইডারে ফালাইয়া গেলাগা…কই পামু মাটি দেওনের ট্যাকা…আপনে বিশ ট্যাকা দিলেন ভাই, আল্লায় আপনের দোয়া কবুল করবে…আপনে পঞ্চাশ দিছেন স্যার, আল্লায় আপনার সব বালামুসিবত দূর করবে।’
আমেনা কাঁদে আর সরু চোখে এদিক–ওদিকে দেখে। ট্রাফিক পুলিশ আসছে? অন্য কোনো ধান্দাবাজ আসেনি তো? তবে কচ্ছপের গায়ে হাড্ডি কম, এর পা দুইটা অসম্পূর্ণ। একে হাড্ডির ধান্দায় কেউ নেওয়ার চেষ্টা করবে না, এটুকু নিশ্চিত। কিন্তু কেটে–ছিঁড়ে পড়াশোনা করার জন্য এর বডি বিক্রি হতে পারে। সব রকম ধান্দাবাজ কিলবিল করে চারদিকে ঘুরছে. ভাবনাটা আসতেই আমেনা অনিরাপদ বোধ করে। পিঠের কাপড়টা টেনে দেয় ভালো করে। তারপর আগের চেয়ে বেশি তারস্বরে কাঁদে। রাস্তার লোকেরা থতমত খেয়ে দ্রুত পয়সা বের করে। আমেনা সেখান থেকে টুক করে কিছু সরিয়ে ব্লাউজের ভেতরে চালান করে। বুকটা ধুকধুক করে, লোকটার পরিচ্ছন্ন বউটা যদি চলে আসে!
তবে আমেনা দেখেছে, এসব নানা অনিশ্চয়তা নিয়েই টাকা রোজগার করতে হয়। ভোটে জেতার আনন্দে ছোটখাটো একটা মিছিল যায় রাস্তা দিয়ে। শব্দের জ্বালায় আমেনাকে কিছুক্ষণ কাঁদতে হয় না। বিশাল চাকাওয়ালা উঁচু গাড়ি রাস্তায় জমে থাকা পানি ছিটিয়ে যায় তারপর। সাদাটে কাপড়ে কিছু কাদা ছিটে আসে। আমেনা খিস্তি করে, ‘বড়লোকের বাচ্চা নাকি শুয়োর! একটা মরা মানুষ শুইয়া আছে, দেখস না?’ এর মধ্যে একজন ফোন তাক করে কয়েকটা ছবি তোলে। আমেনা হাত জোড় করে, ‘ছবি তুইলেন না ভাই, লাশের পাপ হইব।’ ভয়ে ভেতর থেকে তখন সত্যিকারের কান্নাও আসে, কচ্ছপের বড়লোক পরিবারের কেউ যদি দেখে ফেলে ছবিটা! কত ঝুঁকি নিতে হয় কয়টা টাকা কামাইতে!
‘আরে খালা তুমি! কী হইছে তুমার?’
কানের কাছে প্রশ্ন শুনে আমেনা চমকে তাকায়। পিঠের ওপর আধভরা বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। চেনা চেনা লাগে। ছেলেটা বস্তা নামিয়ে বলে, ‘চিনছ আমারে? আমি নান্টু, ওই যে গেল বছর ওভারব্রিজের তলে বসাইয়া দিতা আর রাইতে আইসা নিয়া যাইতা।’
‘ও, তুই? পলাইছিলি ক্যান হারামি?’
‘সারা দিন আমি ভিক্ষা করমু আর রাইতে ট্যাকা নিয়া নিবা তুমি, এইডা কদ্দিন চলে, কও!’
‘এহ্ তরে খাওয়াই নাই রাইন্ধা? আমিই তরে ঢাহা শহর চিনাইলাম আর আমারেই টেক্কা দিবি? যাউগ্যা!’
‘এইখান দিয়া আমি জিনিস টোকাই। এরে এইখানে প্রায় দেহি। জানি নাই যে তুমার স্বামী। আগে দেখতাম ফার্মগেট ওভারব্রিজের ওপরে, ভাবতাম ওঠে কেমনে? একদিন দেখছি ছেঁচড়াইয়া উঠছে।’
হঠাৎ মনে পড়ায় আমেনা আবারও গুনগুনিয়ে কাঁদে, ‘কেমনে আপনেরে মাটি দিমু অহন, ও ছাওয়ালের বাপ, আমারে থুইয়া কই গেলেন গো…’ কান্নার মাঝখানে জানতে চায়, ‘করস কী অহন?’
‘সারা দিন জিনিস টোকাই। ভাঙগারিতে বেচলে যা হয়, তাই দিয়া একবেলা খাইতে পারি।’
‘বাকি দুই বেলা কী করস?’
‘ডান্ডি খাই।’
‘আয় হায়, এইডা ধরছস কেমনে?’
‘ওই যারা বেচে, তারা আগে ফ্রি খাওয়াইয়া শিখাইছে। দেখি খালি খুশি লাগে, নিজেরে রাজা রাজা লাগে। তিরিশ ট্যাকা হইলেই একবেলা হইয়া যায়। প্যাকেটে দেয়, শুইক্কা নিলে আর খিদা লাগে না। কিন্তু তিরিশ ট্যাকায় খাওন হইব, কও?’
‘হ, কিন্তু বাড়িত যাইস নাই আর?’
‘নাহ্।’
‘কস কী, তর মায়ে তরে খোঁজে নাই?’
‘খুঁজবার পারে। মায়ে নানির কাছে রাইখা কামে যায়। নানি খালি মারে। যাউগ্যা। ডান্ডি লইতে লইতে আমার কইলজাডা পেলাসটিক হইয়া গেছেগা, খালা,’ নান্টু বুকের ওপর হাত বোলায়। আমেনা তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তাইলে ভালাই আছস দেহি।’
সূর্যের তেজ কমে বিকেল হতে শুরু করেছে তখন। রাস্তায় ভিড় বাড়ে। ইশ, আরেকটু থাকলে আরও বেশি টাকা আসত। কিন্তু…
‘ওই, তরা লাশ নিবি কখন? সরা সরা, বহুত কান্দন হইছে।’
ট্রাফিক পুলিশ যে এদিকে আসছিল, তা আমেনার চোখে পড়েছে। বেশি লোভ করে কাজ নেই। ধরা পড়লে আম-ছালা সব যাবে। নিজের কোঁচকানো আঁচলে টাকাগুলো বাঁধে সে। ভাবতে পারেনি আজ রোদে টহলদারি না করে, বসে বসেই এত আয় হয়ে যাবে। সাদা কাপড়টার ওপর কয়েকটা খুচরা পয়সা ছড়িয়ে রাখে। ওদিকে ফুটপাতের পাশে ফলের দোকানে দুই মাস্তান এসে চাঁদার জন্য খেচাখেচি করছে। তাদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে আমেনার ভয় ধরে, তার আয়ের ওপর ওদের হাত না পড়ে! টাকাগুলো তোলার আগে তারা দেখে ফেলেছে কি না, এই সন্দেহ আমেনাকে ছাড়ে না।
আমেনা নাক টানে। একবার ডুকরে উঠে চোখ মোছে। তারপর বলে, ‘শোন, নান্টু, এইহানে এট্টু বইসা থাক তো বাপ, আমি খালি যামু আর আমু। কতক্ষণ হইছে মুততেও যাই নাই, লাশ নেওয়ার ব্যবস্থাও তো করতে হইব।’ নান্টু একইভাবে বসে থাকে। সন্ধ্যা গড়ায় প্রায়।
‘কী রে, তরা লাশ নিবি নাকি এইহানেই কবর দিতে চাস?’
ট্রাফিক পুলিশের ধমকে নান্টুর চোখ খোলে। বসে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে গেছিল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, ওদিকে খালার কোনো খবর নাই। নান্টুর কাছে ডান্ডিও নাই যে একটু শুঁকে নেবে। থতমত খেয়ে বলে, ‘আমি কইতে পারি না স্যার।’
‘তর মায়ে কই?’
‘খালা, স্যার। সেই যে গেছে, অহনতরি আইল না।’
‘কস কী! এইডা তো মুনে হয় অন্য কেস,’ ট্রাফিক পুলিশ ফোন করতে থাকেন কোথাও।
‘আমি কি তাইলে যামু, স্যার?’
ট্রাফিক পুলিশ ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রশ্ন শুনে একবার চোখ বোলালেও নান্টুর কথার আর জবাব দেন না। নান্টু ভারী বস্তাটা কায়দা করে পিঠে চড়ায়। খালার সাথে দেখা হয়ে সময়টা নষ্ট হলো। এতক্ষণে ভাংগারি বন্ধ হয়ে গেলে আজ গাম কেনার টাকা হবে না ভাবতেই তার মাথার ভেতর টনটন করে ওঠে। আর তখন খিদে সামলাবে কী দিয়ে!