গোটা শহর লকডাউন হবার ঠিক তেরো দিন আগে শিমুর সাথে রিমনের দেখা হয়েছিল এক বন্ধুর অফিসে। শিমু সেদিন সেখানে এসেছিল একটা সেমিনারের নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে। যে ওষুধ কোম্পানিতে সে কাজ করে, তারা নতুন একটা হার্টের ওষুধ বাজারে আনছে, পাঁচতারা হোটেলে জাঁকজমক করে লঞ্চিং করা হবে তার। কার্ডটা দিয়ে শেখানো হাসি আর সুন্দর কথায় বারবার বন্ধুটিকে অনুষ্ঠানে আসার অনুরোধ করে শিমু বেরিয়ে গেলে রিমনের বন্ধুটি বিরক্ত মুখে কার্ডটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ফালতু। এত নষ্ট করার মতো সময় আছে নাকি আমার? এদের রোজ এই প্রোগ্রাম, ওই প্রোগ্রাম। আরে, তুই আবার উঠছিস কেন? বস, কফি খেয়ে যা।
রিমন উঠে পড়েছে ততক্ষণে। তারও কিছু জরুরি কাজ আছে। রাস্তায় যে ভিড়, তখুনি না বেরোলে নয়। রিমন বা তার বন্ধু তখন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে এই এত শত কাজ আর ব্যস্ততার অজুহাত আর মাত্র কদিন পরই হাস্যকর মনে হবে তাদের কাছে। কেন এত কাজ, কেন এত ছোটাছুটি, জীবন মানে খালি ছুটে চলা, নাকি এক অর্থহীন অপচয়—এই সব প্রশ্ন তখন তাদের বিমর্ষ করে তুলবে। তো বন্ধুর অফিস থেকে বেরিয়ে লিফটে বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে আবার মেয়েটার সাথে দেখা। একটা ভারি ব্যাগ হাতে বিষণ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাতে একা। সন্ধ্যা হয় হয়। মিরপুর রোডে কলাবাগানের সামনের রাস্তায় হলুদ আলো জ্বলে উঠেছে একে একে । যতদূর চোখ যায়, গোটা পথটা একেবারে গিজ গিজ করছে মানুষে। বাসগুলো না থেমেই কাশতে কাশতে চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। রাস্তাজুড়ে নানা রঙের প্রাইভেট কারের সারি। রিকশাও খালি নেই একটাও। গরম পড়েনি তখনো, মার্চের শুরুর দিকে, হালকা একটা বাতাস বইছিল সেদিন। বাতাসে চুল উড়ছিল শিমুর। রিমন তার দিকে চেয়ে হেসেছিল, জবাবে সে-ও হেসেছিল একটু। রিমন কেন যেন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাসায় যাচ্ছেন? কাজ শেষ?’ জবাবে নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ উত্তর দিয়েছিল সে। তারপর রিমন নিজেকে এটাও জিজ্ঞেস করতে শুনেছি Iল, ‘বাসা কোথায় আপনার? কাছেই?’ জবাবে সে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলেছিল, ‘নাহ, অনেক দূর। বাসাবো।’
রিমন এখন ভেবে পায় না, সেদিন একটা অপরিচিত মেয়েকে এত কথা অযাচিতভাবে কেন জিজ্ঞেস করতে গেল সে। পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে এমন আচমকা অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা ঘটে । এই যেমন এর ঠিক তেরো দিন পরই চারপাশের সমস্ত কোলাহল অকস্মাৎ থেমে গিয়ে এই শহরটা একটা মৃত শহরে পরিণত হল। হাজার হাজার মানুষ উধাও হয়ে গেল রাস্তা থেকে, ফুটপাত, অফিসপাড়া আর স্কুল-কলেজের সামনের জায়গাগুলো জনহীন হয়ে পড়ল, শহরের সব আলোজ্বলা বিরান খাঁ খাঁ পথে কেবল ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকল কয়েকটা সাইরেন বাজানো অ্যাম্বুলেন্স আর রাস্তার ঘেয়ো কুকুর। শহরের সিগন্যালগুলোতে রোজকার চেনা বেলী ফুল হাতে বালিকারা কি উৎকট সাজের হিজড়ারাও অদৃশ্য হয়ে গেল ভোজবাজির মতো, যারা এই শহরের অনিবার্য অংশ ছিল এত দিন। তেমনি শিমুর সাথে আলাপটাও ছিল একটা আশ্চর্য আকস্মিক, কিন্তু অনিবার্য ঘটনা। এর কোনো ব্যাখ্যা হয় না।
তো আলাপ জমার একটু পর শিমুকে সে প্রস্তাব দিয়েছিল তার মোটর সাইকেলে বাসায় পৌঁছে দেবার। শিমুও কী ভেবে যেন রাজি হয়ে গিয়েছিল তার কথায়। তারপর তারা এই যানজটে অচল ঢাকা শহরের স্থবির সিগন্যালে সিগন্যালে অনেকগুলো প্রহর কাটিয়েছিল। কখনো কথা বলছিল, কখনো চুপ করে ছিল, কখনো হাসছিল। কিন্তু এই ভিড় আর যানজট তাদের কাছে সেদিন আগের মতো অসহনীয় লাগছিল না আর, সময়টাকেও দীর্ঘ মনে হচ্ছিল না তত, বাড়ি ফেরার তেমন তাড়াও বোধ করছিল না। রিমন সে রাতে অবাক হয়ে ভেবেছিল যে স্রেফ একটা মানুষের সাথে পরিচয় চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলোকে কী আশ্চর্যভাবে পালটে দেয়! পরবর্তী তেরো দিনে, কি তারপর শহরটা অবরুদ্ধ হয়ে যাবার পরও, শিমুর সাথে রিমনের আর দেখা হয়নি। তবে কথা হয়েছে অনেক। প্রায় প্রতি রাতে। প্রায় সারা রাত। অবরুদ্ধ প্রতিটি রাত।
তারপর এই লকডাউনের ষোলো দিন পর, মানে শিমুর সাথে দেখা হবার ঠিক উনত্রিশ দিন পর রিমন এই প্রথম তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মাথার মুদি দোকানটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। শহরটাকে ভীষণ অচেনা লাগছে তার। অচেনা, মৃত আর ঠান্ডা। একটা দুটো বিক্ষিপ্ত রিকশা চলছে দিকনির্দেশনা ছাড়াই। এলিফ্যান্ট রোডের সারি সারি সব দোকানের শাটার টানা, সিগন্যালে লাল-হলুদ-সবুজ বাতির অকারণ রং বদল মেনে চলাবার মতো কোনো যানবাহন নেই রাস্তায়। চিরচেনা ফুটপাতে নেই পসরা আর ক্রেতাদের ভিড়। মোড়ের বড় গাছতলায় ‘রমিজের তালা চাবির দোকান’ লেখা একটা টিনের বাক্স কাত হয়ে পড়ে আছে একাকী। ঝুলন্ত তারে ছেঁড়া পোস্টার আর ফাঁকা রাজপথে রাজার হালে শুয়ে থাকা একটা কুকুর তাকে যেন আড়চোখে দেখছে। রিমন সন্তর্পণে একটা নিশ্বাস নেয়। এই দূষিত শহরে আজকাল মানুষ নিশ্বাস নিতেও ভয় পায়।
রিমনের অফিসটা সেই মার্চের শেষে হোম অফিস হয়ে গেলেও শিমুকে মাঝেমধ্যেই বের হতে হয়েছে। ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে এই দুর্যোগেও দোকানগুলোতে ওষুধের সাপ্লাই চেইন তদারক করতে যেতে হয়েছে তাকে। যেতে হয়েছে নানা হাসপাতালে, ওষুধের সংকট আছে কি না দেখতে। এত দিন শিমুর কাছেই এই মৃত নগরীর ভয়াল বর্ণনা শুনেছে রিমন। শিমু মেসেঞ্জারের ভিডিও কলে ফিস ফিস করে বলেছে, ‘তুমি বিশ্বাস করবে না, শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভূত, যেমনটা গ্রামের অন্ধকার ধানখেতে বা বাঁশঝাড়ে গভীর রাতে দাঁড়িয়ে থাকে, সাদা শাড়ি পরা, তালগাছের মতো, লম্বা লম্বা হাত-পা। এ শহরের প্রতিটি মোড় পেরোতে গিয়ে এখন মানুষের গা শিরশির করে ওঠে। মনে হয় যেন পেছনে কে আছে, কে যেন চুপিসারে আসছে পায়ে পায়ে। কার যেন লম্বা ছায়া পড়ে থাকে নির্জন পথে চাদেঁর আলোয়। কী আশ্চর্য রিমন, এই শহরটা এমন হয়ে গেল? চোখের সামনে?’
শিমুর সাড়ে চার বছরের স্পেশাল চাইল্ড রূপকথা ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের আলো কমিয়ে দিয়ে আধো অন্ধকারে অনেক রাত অব্দি সে রিমনের সঙ্গে এই সব কথা বলে যেত ফিস ফিস করে। রূপকথা বেশি আলো বেশি আওয়াজ পছন্দ করে না। তার পছন্দ নীরবতা। লকডাউনের আগের পৃথিবীটাকে অসহ্য লাগত রূপকথার। ঘর থেকে বেরোতে চাইত না, স্কুলে যেতে চাইত না, কারও বাসায় যাওয়া তো নয়ই। এমনকি সিঁড়িতে লিফটে কাউকে দেখলে মায়ের পেছনে সিঁটিয়ে থাকত সে। মায়ের হাতের আঙুলগুলোর ভেতর নিজের আঙুলগুলো পুরে শক্ত করে ধরে রাখত সারাক্ষণ। এখন এই কোলাহলহীন নিঃশব্দ শহর, বারান্দায় উড়ে আসা শ্বেত কবুতর, সকালবেলা বারান্দায় ফোটা একটা নীল অপরাজিতা ফুল আর মাকে সারা দিন কাছে পাবার আনন্দ তাকে অনেকটাই স্থিতি এনে দিয়েছে। ‘রূপকথার অস্থিরতা অনেক কমে গেছে জানো,’ মোবাইলের স্ক্রিনে শিমুর চেহারার অর্ধেকটাই অন্ধকার দেখায়, অন্ধকারেও বেশ বোঝা যায় তার খুশি খুশি ভাবটা, ‘কে জানে পৃথিবীটা হয়তো এমনই হবার কথা ছিল, আমরাই হয়তো এক ভুল গ্রহে বাস করতাম!’
রিমন রিকশাওলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, বাসাবো যাবেন?’ বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা কয়েক মুহূর্ত ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ওই দিকে যাওন যাইব না, পুলিশে ধরে।’ রিমন অগত্যা প্রায়ান্ধকার নির্জন মেইন রোড ধরে হাঁটতে শুরু করে দিল। পিচ ঢালা কালো রাস্তাটা ভেজা, বাতাসে জীবাণুনাশকে উৎকট গন্ধ, হয়তো এইমাত্রই ছিটিয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের গাড়ি। পেছন থেকে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ডাক দিল তখন, ‘ভাইজান, আপনেরে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত আগায়া দিয়া আসি? এক শ টাকা দিয়েন।’ রিমন উঠে পড়ল রিকশায়। ঠিক করল বুড়াটাকে দুই শ টাকা দেবে। হয়তো একেবারেই নিরুপায় হয়ে পুলিশের ঠ্যাঙানির ভয় উপেক্ষা করে পথে নেমেছে লোকটা। সে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা, মাস্ক পরেন নাই ক্যান?’ বুড়া উত্তর দিল না কোনো, দুদিকে মাথা নাড়ল কেবল একটু। পরনে কাপড় আর পেটে ভাত না থাকলে মাস্কে কি আর মরণ আটকানো যায়? ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে ফোন বের করে শিমুকে কল দিল রিমন। রিং বাজল অনেকক্ষণ। অনেকগুলো রিং বাজার পর ওপাশে শোনা গেল শিমুর ক্ষীণ কন্ঠ, ‘রি-ম-ন।’
‘শিমু। এখন কেমন লাগছে? আমি আসতেছি। পথে এখন।’ উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলল রিমন।
‘ভা-লো না।’ অনেক কষ্টে কথাটা বলতে পারল শিমু। থেমে থেমে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে। ‘আমার দম আটকে যাচ্ছে কেমন যেন। মনে হচ্ছে…মনে হচ্ছে যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছি।’
‘একটু অপেক্ষা করো। আমি এসেই হাসপাতালে নিয়ে যাব তোমাকে। চাচা, একটু জোরে চালান দেখি।’ রিমনের বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে এখন। সকালেই না শিমু কত হাসি-ঠাট্টা করল ফোনে!বুড়া চাচা একবার পেছন ফিরে দেখে নিল তাকে। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘হাসপাতালে নিয়া ফায়দা নাই ভাইজান। কেউ নিব না। এই কয় দিনে কত দেখলাম। খামাখা দিগদারি।’
রিমন কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘টেস্টের জন্য লোক আসতেছে। যদি তাদের সাথেই নিয়ে যাওয়া যায়। দেখি।’ বুড়া চাচা নিঃশব্দে হাসল। একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে ছুটে গেল পাশ দিয়ে। রমনা পার্কের সামনে একটা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। বুড়া চাচা মুখ নিচু করে জোরে প্যাডেল চালিয়ে পেরিয়ে গেল জায়গাটা। পুলিশ তাদের লক্ষ করেনি।
‘লকডাউন খুলে দিলে রূপকথা আর তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব,’ কাল রাতেই বলেছিল রিমন। তখনো শিমুর কেবল একটু ঘুসঘুসে জ্বর আর খুসখুসে কাশি। আদা-লবঙ্গ দিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে শিমু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায়?’
এখন বলব না। জায়গাটা আমার খুব পছন্দ। রূপকথারও পছন্দ হবে। ভিড় নাই। লোকজন নাই।
আচ্ছা। তার আগে রূপকথাকে তোমার সাথে ভাল করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ও তো অপরিচিত মানুষ ভয় পায়।
জোরে হেসে উঠেছিল রিমন, ঠিক তার মায়ের বিপরীত। ওর মা অপরিচিত লোকদের একেবারেই ভয় পায় না! হা হা হা।
শেষ রক্ষা আর হলো না। মৎস্য ভবনের সামনে রিমনকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিল পুলিশ। হাতের লাঠিটা দিয়ে রিকশার চাকায় বাড়ি দিয়ে পুলিশটা ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন বাইর হইছেন?’আমার এক আত্নীয় অসুস্থ। প্লিজ, আমাকে যেতে হবে।
‘হাসপাতালে ফোন দেন। আপনে কেন যাবেন? জানেন না বাইর হওয়া নিষেধ? অ্যাই, যাহ।’ রিকশাটাতে একটা বাড়ি দিয়ে বিদেয় করে দিল পুলিশটা। অগত্যা রিমন নেমে হাঁটা দিল। আকাশে আজ বড় গোল চাঁদ। চাদেঁর আলোয় সত্যি গা শিরশির করছে ওর। প্রধান বিচারপতির বাসভবন পার হতে গিয়ে তার মনে হলো যেন অন্ধকার বাঁশঝাড় পার হচ্ছে। তালগাছের মাথায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে শাকচুন্নি। হাসছে হি হি হি হি করে। পকেট থেকে ফোন বের করে আরেকবার শিমুকে ফোন করল সে। রিং বাজল অনেক, কিন্তু কেউ ধরল না। শিমু কি ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত হয়ে? রিমন চলার গতি বাড়িয়ে দিল এখন। রূপকথার বাবা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু জিজ্ঞেস করেনি রিমন। তিনি এখন কোথায়, কীভাবে তার সঙ্গে শিমুর ছাড়াছাড়ি হলো, তার সাথে ওদের কোনো যোগাযোগ আছে কি না—এর কোন কিছুই শিমু তাকে কখনো বলেনি। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। শিমুর মতে, রূপকথা এক স্বর্গীয় শিশু। সে এ পৃথিবীর কেউ নয়। এই পৃথিবীর কারও সাথে তার মিল নেই। তাই কে তার বাবা, কে মা—তাতে কিছু যায় আসে না। শিমু এ রকম আরও কত অদ্ভুত কথা বলে। যেমন বলে, ‘তুমি কি জানো, আমার না এই বন্দী দশাতেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি মুক্ত লাগছে জীবনে। যখন বাইরে যেতাম, নানা কাজে ঘুরতে হতো, অফিস যেতাম, নানা লোকের সাথে দেখা করতে হতো, হাসতে হতো, তখনই কেমন যেন বন্দী বন্দী লাগত। হাঁসফাঁস করত ভেতরটা। এখন দেখো। কী স্বাধীনতা!’
প্রথমে গলিটা চিনতে একটু ভুল হলো রিমনের। সেই কবে একবার এসেছিল শিমুকে নামাতে, লকডাউনের তেরো দিন আগে, এক কোলাহলময় জনাকীর্ণ সন্ধ্যায়। সেদিন বাসাবোর গলিগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। মোটরসাইকেলের হর্ন বাজাতে হচ্ছিল বারবার। পথচলতি মানুষ একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়ছিল। আজ সব সুনসান। যেন এখানে এই জনপদে কোনো মানুষ বাস করে না আর। দুধারে দোকানগুলোর সামনে জমাট অন্ধকার। ফুটপাতগুলো উদোম পরিষ্কার। মসজিদে এশার আজান হচ্ছে বিষণ্ন সুরে। কারও তাড়া নেই সে আহ্বানে সাড়া দেবার। দুবার ভুল করে তারপর ঠিক গলিটার মাথায় এসে থামল রিমন। ঘামে তার শার্ট জবজব করছে। এতটা রাস্তা জোরে জোরে হেঁটে আসার কারণে বুক ধড়ফড় করছে এখন। কিন্তু গলির মাথার লোহার গেটটা যে বন্ধ। তার সামনে আবার বাঁশ দেওয়া। সে কিছুক্ষণ গেটটা ধরে ঝাঁকুনি দেবার পর দুটি যুবক বেরিয়ে এল অন্ধকার ফুঁড়ে, ‘কী অইছে? কী চান?’
আমি ওই তেত্রিশ নাম্বার বাসায় যাব। আমার আত্মীয় থাকে ওখানে। অসুস্থ।
‘অসুস্থ? কে? কোন বাসায়?’ চেহারা পালটে গেল যুবক দুটোর। চঞ্চল হয়ে উঠল যেন তারা। কে যেন কাকে চিৎকার করে ডাকল, ‘অ্যাই দ্যাখ তো। সিদ্দিক চাচার বাড়িত বলে কে অসুস্থ?’
আরও কয়েকজন জুটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। একজন মধ্যবয়সী লোক, লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা, ঠোঁটের কোণে পানের রস, গেটের ওপার থেকে সন্দেহ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনে কেডা? পরীক্ষা করার লোক?’
না, আমার নাম রিমন। আমি ওই বিল্ডিংয়ের একজনের আত্নীয়।
এই গলি লকডাউন। জানেন না? কেউর ঢোকা নিষেধ। আপনে ঢুকতে পারবেন না।
ভাই, ওকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আমি অ্যাম্বুলেন্স বা একটা সিএনজি ডাকতেছি। তাকে নিয়েই চলে যাব।
লোকগুলো সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘না না। কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকব না এই গলিতে। পরীক্ষা করার লোক আসছিল। আমরা ঢুকতে দিই নাই। এই সব খারাপ জীবাণু নিয়া কেউ ঢুকতে পারব না কইলাম।…অ্যাই, সিদ্দিক চাচারে খবর দে। ওই ফ্ল্যাটে তালা দিয়া দিতে ক। কেউ যেন না বাইর হইবার পারে।’
রিমন হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এসব কী বলছেন? ওকে এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার। প্লিজ, আমাকে যেতে দেন। সে বাচ্চা নিয়ে একা থাকে বাসায়।’
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল একজন, ‘কইছিলাম না? ওই মাইয়াডা! আমগো পাড়ায় জীবাণু ঢুকাইছে। আমি তখনই সিদ্দিক ভাইরে কইছিলাম, এই রকম মাইয়ারে বাসা ভাড়া দিয়েন না। অহন বুঝো!’ তার কথা শেষ হতে না-হতেই অনেক শোরগোল হতে থাকলে। রিমন আবার ফোন করতে লাগল শিমুকে। কেউ ধরল না সেই ফোন। সে এলোপাতাড়ি অনেকগুলো ফোন করল এর পর। তার অফিসের বসকে। জরুরি সাহায্যের নম্বরে। পরীক্ষা করার সেই হটলাইনে। তার সেই বড় কর্তা বন্ধুকে। সব কটিই বিজি। নয়তো কেউ জবাব দেয় না। বন্ধুটা সব শুনে ‘ভাই এখন কিছু করতে পারব না, বুঝতেছিস না লকডাউন’ বলে ফোন রেখে দেয়। কী করবে বুঝতে না পেরে একসময় রিমন পা দিয়ে লাথি দিতে শুরু করল বন্ধ গেটে। ‘খোলেন গেইট, খোলেন গেইট। আপনারা কি মানুষ? খোলেন বললাম। না হলে আমি থানায় যাব।’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিরাট গোলমাল বেধে গেল জায়গাটাতে। কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইছে গেট থেকে, কেউ শার্টের বোতাম ছিঁড়ে নিচ্ছে, কেউ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে লাঠি দিয়ে মারবার চেষ্টা করছে, কেই লাথি দিচ্ছে ইচ্ছেমতো, কেউ চুল ধরে টানছে। জোর ধাক্কায় একসময় রিমন ছিটকে পড়ে গেল রাস্তায়। একেবারে চিত হয়ে। তার ঠিক মাথার ওপর আকাশ। আকাশে বিরাট বড় গোল এক চাঁদ। এ রকম পীত বর্ণের অশুভ চাঁদ সে এর আগে কখনো দেখেনি। শিমু ঠিকই বলেছিল। এই মৃত শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রেতাত্মাগুলো। লম্বা, সাদা, শীর্ণ তাদের পা। তাদের চোখগুলো হলদে, জ্বলজ্বলে। বড় বড় নখ। টকটকে লাল জিব। এভাবে, লকডাউনের ঠিক ষোলো দিন পর, মানে শিমুর সাথে দেখা হবার ঠিক উনত্রিশ দিন পর, যে মেয়েটার সাথে তার একটা ‘প্রেম হলেও হতে পারত’ অবস্থা চলছিল, তার বাড়ির ঠিক বিশ গজ দূরে রাস্তায় শুয়ে রিমনের চোখের সামনে তার পরিচিত শহরটা একটা শ্মশানে পরিণত হল হঠাৎ। সেই শ্মশানে সারি সারি কবর আর এপিটাফ, কুয়াশার মতো সাদা ধোঁয়া চারদিকে। আর তার চারপাশে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকা শহরের প্রেতাত্মারা।