চৌরাসিয়ার বাঁশির রেশ মিলিয়ে এলে দুই বছর ধরে নিরুর মন খারাপ হয়ে যায়। আগামী বছর কি এই মানুষটার সুর শুনতে পাবে! আবার ধরা যাক, দিন দুই আগে সারা মাঠে কোলাহল, ফুডকোর্টে ভিড়, সেই সময় হঠাৎ আকাশজুড়ে বৃষ্টি শুরু হলো, আসলে বৃষ্টি নয়, ওস্তাদ জাকির হুসেনের বাদন বিভ্রম তৈরি করেছে। পুরো মাঠ তখন শীতল ও নীরব। এই হচ্ছে সত্যিকারের শিল্প, সৃজনের সামনে চুপটি করে বসে থাকা লাগে, নয়তো সব মাটি। এখন এই ভোরবেলা, নির্ঝরদা আর কনাদির পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে ভাবছিল, ছয় দিন পর আজ নিজের শহরে ফেরা। শামীম ভাই কেমন আছেন কে জানে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা একহারা শামীম ভাই, শহরের নানা ফুটপাতে বই বিক্রি করে যাচ্ছেন। কত দুষ্প্রাপ্য বই না সে কিনেছে একসময়! এখনো, ওই যে পুরোনো বইয়ের মধ্যে একটা টাইম ট্রাভেলের মতো ব্যাপার আছে না? ধরা যাক, আইকোনোগ্রাফি নিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর বইটা, সেই কোন ১৯২৯ সালে বেরিয়েছিল, মাত্র দুই শ টাকায় মিরপুর দশের ফুটপাত থেকে কেনা, তারপর তো সংগ্রাহক বন্ধুদের কেউ কেউ অনেক টাকা দিতে চাইল, কিন্তু বইটা বুকের ওপর নিয়ে শুয়ে থাকার সুখ কি এই টাকা দিতে পারবে? এখন জুয়েলের সঙ্গে যাচ্ছে উত্তরা এয়ারপোর্টের কাছেই, খানিক ঘুমিয়ে নিতে। আকাশ পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। এত ভোর ভোর কাগজ কুড়াতে বেরিয়ে পড়ল কেন মিশকালো শুকনো বাচ্চাটা!
সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আবার ছুট। এবার বসুন্ধরা, নর্থ সাউথের সামনে। অপরাজিতা অপু একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে আসবে। অপু আর নিরুর একান্ত সময় বলতে অল্প একটু রিকশায় ঘোরা আর গুলশান–২–এর কফিশপে বসা। ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, এলেই যদি আরেকটু আগে আসতে, আমি এখন চৌত্রিশ, তুমি একুশ কিংবা আমি যদি আরেকটু পরে জন্মাতাম…তুমি কত ছিপছিপে, প্রজাপতির চেয়েও দ্রুত উড়ে বেড়াও আর আমার এখনই জীবন অসহ ভার মনে হয়। ভাগ্যিস, তুমি ছিলে। অপু বেরিয়ে এসে প্রথমেই ওকে প্রশ্ন করে, ‘এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? ব্রেকফাস্ট করোনি?’—এই ব্যাপারটা খালি মায়েরা বোঝে আর প্রেমিকারা। ‘তোমার সাথে অনেক দিন খাই না’—কথাটা শুনে অপু হাসে। একটা চড়ুই একবার মাথা উঁচু করে ওর হাসিটা দেখে নেয়। রেস্তোরাঁর কেবিনে অপু ওকে খাইয়ে দেয়, ভালো লাগে। খানিকটা ডাল অপুর ঠোঁটে লেগে থাকলে নিরু আঙুল দিয়ে তুলে নেয়, হাসে দুজনেই। রোদ এখন বেশ উজ্জ্বল, নার্সারির বাচ্চাদের মতো দুরন্ত। দুপুর সোয়া ১২টার পরও গুলশান–২–এর এই কফিশপ ফাঁকা থাকে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একবিন্দু নিভৃতি আছে। কে না জানে, আপামর বাঙালি জুটি শ্বাসরোধী এই সময়ে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেলে কাজে লাগায়, যেমন অনেক সময় শখের মাছশিকারি ছোট মাছ পেলে ছুড়ে দেয় আবার জলে আর মাছের শরীর প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠে! সিঁড়িতে মাছের লেজের ওই ক্ষণচঞ্চলতার পরে গরম কফি। অপু, তোমার কমবয়সী আঙুল যখন আমাকে স্পর্শ করে আমার শরীরের অর্ধন্মৃত কোষেরা প্রাণ ফিরে পায়। দোকানজুড়ে কফির সুগন্ধ ছাপিয়ে আমার অস্তিত্বের দিগন্তে তোমার ঘ্রাণের পতাকা উড়ছে। তিমি মাছ মেরে ঠোঁটের রং বানায় সে জন্য তুমি তোমার ওষ্ঠ ও অধরে কোনো অপ্রাকৃতিক রঙে বিশ্বাস করো না। কোনো রকম পারফিউম তোমার পছন্দ নয়, আমি কি এ জন্যই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম? মনে পড়ে একদিন বলেছিলে, ‘সিগারেটের গন্ধ আসছে তো শরীর থেকে, ছেড়ে দিতে পারো না?’, আমি তো বিশ্বফিচেল, বলে ফেলেছিলাম, ‘প্রকৃতিতে এমন কোনো বিশুদ্ধ চুমুর অপেক্ষা কি আছে যার জন্য ঠোঁট বিশুদ্ধ রাখা যায়?’ তখনো আমাদের ঠোঁটবিনিময় ঘটেনি। তুমি প্রস্তুত হতে না দিয়েই আমাকে জড়িয়ে একটা চুমু…আনাড়ি কিন্তু সচেষ্ট। ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের নিচের দিকের সিঁড়ির ধাপ। ঠিকঠাক হয়ে বসতে না বসতে পাশ দিয়ে ২২ বছরের তরুণের মতো নেমে গেলেন ঢালী আল মামুন। চেনা দিলেন আমায়।
‘কী ভাবছ?’ অপুর প্রশ্নে চারুকলার সকালের নির্জনতা থেকে রেস্তোরাঁয় ফেরে নিরু। ‘আমাদের প্রথম চুমুর কথা’। অপু যখন হাসে তার চোখ হাসে, কেবল চোখ নয় তার সারা শরীর হাসে। ‘তোমার কি এখন আবার চুমুর তৃষ্ণা পাচ্ছে?’ অপুর সরাসরি প্রশ্নে নিরু লজ্জা পায়। এখনো লজ্জাবোধ আছে ভেবে আরেকবার হেসে নেয় মনে মনে। লোভ তো হয় কিন্তু তাড়াতাড়ি নিজের শহরে যেতে হলে এখন ওঠা দরকার। আগে মামার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। সে হেসে মাথা নাড়ে। মিরপুরের বাসে তুলে দিয়ে অপু দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ পরস্পরকে দেখা যায় তাকিয়ে থাকে, দুই সীমান্তের কাঁটাতার থেকে যেমন দেশ ভাগ হয়ে যাওয়া আত্মীয়েরা পরস্পরকে দেখে। নিরু তারপর ঘুমিয়ে পড়ে, পূরবী সিনেমার সামনে তাকে ডেকে দিতে বলে।
দুই.
হোটেল ব্রিজে এমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে ভাত খেতে খেতে নিরুর মনে পড়ে, অভিযাত্রিক বইতে পড়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এসেছিলেন। আটের দশকের শেষের যে বৃক্ষবহুল কোর্ট বিল্ডিং তার সঙ্গে এখনকার কোনো মিল নেই। তখন সকালে পাথরঘাটা গির্জার গম্ভীর ঘণ্টা বেজে উঠলেই সে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত, বাবা–ছেলে সাত–আট পাক ঘুরত পুরো এলাকা, সকালের পরিষ্কার বাতাস আর নানা রকম ফুল, গাছ, লতার গন্ধে ভরে থাকত আর সকাল আরেকটু ঘন হলে সেন্ট প্লাসিডের দিকে হাঁটা। মিশনারি স্কুলের মজা হচ্ছে সব পরিপাটি। ব্রাদার র ্যালফ তত দিনে আর নেই। পড়ায় ভালো করলে চকলেট দিতেন। এখন নোয়েল স্যার মূর্তিমান বিভীষিকা, কুইজে ফুল মার্ক পেলে সুন্দর স্টিকার দিতেন, আবার পিটুনি দিতেন খারাপ নম্বর পেলে। বর্ধন স্যার শেখাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা, নিরুর আঁকাটা শেষ দিকে থেঁতলে যাওয়া বানরের হতচ্ছাড়া দশার মতো হয়ে যেত। খাওয়া শেষ হতে ওরা এমদাদ ভাইয়ের ফুটপাতের দোকানে আসে। পুরোনো ম্যাগাজিনের গাদায় প্লেবয় পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা পেয়ে বিস্মিত হয়। তিপ্পান্ন সালের ডিসেম্বরে পঞ্চাশ সেন্ট দামের চুয়াল্লিশ পেজের কাগজ। দেখা যাচ্ছে, মেরিলিন মনরোর ন্যুড ফটোগ্রাফ এবং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের হোমসের গল্প পাশাপাশি। কয়েকটা বই–পত্রিকা কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবে, তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘা শুকোয়নি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে দুনিয়ার দেশে দেশে তখনো মার্কিন ও সোভিয়েত সেনাশিবির। তখন অন্তর্জালের প্রমোদ সুদূরের জিনিস। ফলে এই সব পত্রিকার কল্পনাবিলাস উসকে দিয়ে যুদ্ধক্লান্ত, সদাসতর্ক স্নায়ুকে খানিক শিথিল করা যেত। আজ বাসায় কেউ নেই, বাবা–মা হাসপাতালে গিয়েছেন আর ছোট বোন স্টাডি ট্যুরে বগুড়া।
দুপুরের পর অপু আসতে না আসতেই ঝুমবৃষ্টি। তার হাতে দুজনের মতো খাবার। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে নিতে বলে পিসি অন করে। বের্তোলুচির ড্রিমার্স হোক আরেকবার। নিরু মাংসাশী। ‘আজ সিনেমা না দেখলে হয় না?’—অপুর প্রশ্নে সে অবাক হয়, এবার বিস্তারিত জানা যায়, একটা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে গিয়ে কাল তেমন ঘুম হয়নি। নিরুর গভীর মায়া হয়, ‘ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমালে কেমন হয় ঘণ্টা দুই?’—ওর প্রস্তাবে অপু হাসে, পৃথিবীর সুন্দরতম প্রেমিকার মতো এগিয়ে এসে সে নিরুর কপালে চুমু খায়। তারপর সোজা ঘুমিয়ে পড়ে। অল্প পরে, সে দেখে মাতৃগর্ভে যেভাবে একটি শিশু ঘুমায়, সেইভাবে অপু ঘুমাচ্ছে। খুব লোভ হয় তার, সে–ও পাশে শুয়ে পড়ে। দেয়ালের গায়ের এক টিকটিকি দুজন মানুষের বাচ্চাকে শুয়ে থাকতে দেখে ফিসফিস করে বলে, ‘এই তোমাদের প্রথম একত্র ঘুম, এই তোমাদের শেষ একত্র ঘুম।’ তখন বাস্তবে ও স্বপ্নে দুজনের ঘুমের মধ্যেই বৃষ্টি পড়তে থাকে। তারা পরস্পরকে আরেকটু আঁকড়ে নেয়, ঘুমের মধ্যেই তারা পরস্পরে লীন হতে চায়। বাস্তবে পারে না।
তিন.
সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পর দিন দীর্ঘ হয়ে যায়। হাত দুটোকে অর্থহীন লাগে। এখন জীবনে অপরাজিতা অপু নামের মেয়েটি নেই। জিতে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই, কেবল হেরে যাওয়া। শহরের ফুটপাত আরও নিরাপদ হয়ে উঠেছে, কোনো ভাঙাচোরা মানুষ দুষ্প্রাপ্য বই নিয়ে বসে না আর। উঁচু–নিচু মানুষের বাচ্চারা নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারে। এমদাদ ভাই গ্রামে চলে গিয়েছে, খোঁজ নেই। দিন দীর্ঘ হলে রাত দীর্ঘতম।
নিরু বিয়েটা করেছিল নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে। সে–ও থাকল না। অথচ মেয়েটির পায়ে আলতা লাগাতে সে খুব ভালোবাসত। আরও দু–দশটা বাঙালি পুরুষের মতোই নিজের বউকে ভালোবাসার চেষ্টা সে করেছিল বৈকি। কিন্তু বউটা তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আর ফিরল না। ফোনে বলে দিল, ফিরবে না। অথচ আগের দিনও ওরা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে। নিরুর কাছে দাবা খেলা শিখে ওকেই হারিয়েছিল কতবার! মেয়েটার সেন্স অব হিউমার ছিল অকল্পনীয়। একদিন রাত জেগে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে গেমস খেলছে নিরু, অনেক রাতে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, ‘যে খেলায় ভবিষ্যৎ নেই সেটা খেলে লাভ নেই।’ এই সব মনে পড়লে নিরুর হাসি পায় একা একা। সম্পর্কের শুরুর দিনেই, অনেক কাল হলো, সে শেষটুকু বুঝে ফেলে। সেই জন্য বোঝাতে যায়নি, তর্ক করতে যায়নি। বরং যে বউটা কদিন ছিল তার জন্য দুহাত তুলে ব্যক্তিগত, নির্জন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, ও আনন্দে থাকুক। ওর নির্জন বিপন্ন ঈশ্বর কাঠবিড়ালির ওপর ঝরিয়ে দেন বাদাম ও আখরোট।
অবসাদে চোখ লেগে এলে একদিন একজন মধ্যবয়সীকে দেখে, একটা মাঠে উবু হয়ে কী যেন খুঁড়ছেন। একটু এগিয়ে যেতেই বোঝে নলিনীকান্ত ভট্টশালী কিছু একটা খুঁজছেন।
নিরু আর নলিনীকান্ত সমবয়সী বন্ধুর মতো একটা গাছের নিচে আড্ডা দিতে থাকে, স্বপ্নের ভেতর।