খুন করেছিস কেন? খগেনকে জিজ্ঞাসা করেন থানার দারোগা। খগেন চুপ করে শোনে। জবাব দেয় না। হাবিব চেয়ারম্যানকে হত্যার মামলায় ওকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার বিবরণ মোতাবেক, রাতের অন্ধকারে হাবিব চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত চেয়ারম্যানকে প্রথমে চেতনানাশক কিছু শুকিয়ে অজ্ঞান করেছে, এরপর তার হাত দুটো খাটের সঙ্গে বেঁধে ধারালো বঁটি দিয়ে গলাটা কেটেছে। বঁটিটা পাওয়া যায়নি, কিন্তু বাদীপক্ষ কেসের বিবরণে এমনটি বলেছে। বাদী চেয়ারম্যানের দুই ছেলে।
খগেনের বাড়ি চেয়ারম্যানের বাড়ির ডান পাশের প্রাচীরের ওপাশে। প্রাচীরটা হাত-পা ছড়াতে ছড়াতে খগেনের উঠোনের প্রায় সবটুকু খেয়ে ফেলেছে। আর একবার ধাক্কা দিলেই ওর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু গর্তে গিয়ে পড়বে। একসময় চেয়ারম্যানের বাড়ির জমিটুকুসহ এখানে অনেকটা জায়গা খগেনদের ছিল। বেশি দিন আগের কথা না, এই ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে। খগেনের দূরের স্মৃতিতে কিছু কিছু দৃশ্য এখনো টিকে আছে। সে নিয়ম করে কৃষাণের হেঁসু ধার দেওয়ার মতো করে এই সামান্য স্মৃতিটুকু শাণ দিয়ে রাখে।
খগেনের কাজ ছিল রোজ ঘুম থেকে উঠে চেয়ারম্যানকে একচোট গালিগালাজ করে নেওয়া। এরপর বগলে লাঠি আর কাঁধে ঝোলাটা গুঁজে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যায় যখন ফেরে, তখন আর গালাগালি করে না। হারিয়ে যাওয়া সংসার, জন্ম না-নেওয়া সন্তানের কথা মনে করে কাঁদে। অনেক রাত পর্যন্ত ওর ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে। কিন্তু সকাল হলেই খগেন ফের বদলে যায়। যা-তা বলে চেয়ারম্যানকে গালি দেয়। এর মধ্য অনেকবার সে খুন করার ইচ্ছাও প্রকাশ করে। যে রাতে খুন হলো, সেদিনও বলে গেছে, ‘আজ তোকে না মেরি আমি রাইত পার করবু না।’ এ কথা পাড়ার আরও পাঁচটা লোক শুনেছে। তাই ভোরে যখন একা ঘরে এই সাবেক চেয়ারম্যানের লাশটা পাওয়া গেল, গলাকাটা অবস্থায়, কেউই আর দ্বিধায় থাকেনি যে খুনটা খগেনই করেছে। খগেনকে আসামি করার বিষয়ে চেয়ারম্যানের ছেলেদের একবারও ভাবতে হয়নি; বরং সুবিধাই হয়েছে। খগেন নিজেও এর প্রতিবাদ করেনি। পুলিশ যখন এসে বলল, ‘তুই খগেন?’ তখন খগেনকে দেখে পুলিশের বুঝতে অসুবিধা হলেও সে দিব্যি পুলিশের সামনে গিয়ে বলল, ‘আমাকে তো বাঁধতি পারবেন না। গাড়িতে উঠি দেন। আমি পালাবু না।’ তখন আর তারা কোনো কথা না বাড়িয়ে খগেনকে ধরে নিয়ে গেল।
খগেন জানে, চল্লিশ বছর ধরে একটা খুন সে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছে। এমনকি কত স্বপ্নে খুনটা সে করেও ফেলেছে। সকালে উঠেই নিজের অক্ষমতার জন্য আফসোস করেছে। কিন্তু আজ যখন সত্যি সত্যি জানতে পারল চেয়ারম্যান খুন হয়েছে, একবারও মনে হয়নি খুনটা সে করেনি। কিন্তু সে মনে করতে পারছে না খুনটা সে কীভাবে করেছে। তাই দারোগা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তোর কাজ?’
‘জে, হতি পারে।’ সে সরাসরি উত্তরটা দিতে পারে না।
‘হতে পারে মানে? কোনো সন্দেহ আছে?’
‘খুনটা আমারই করার কতা। ক্যান্ত আমার কিছু মনে পড়চি না। রাতি একবার বাজ্জি পেয়ি ঘরের বাইরি গি দ্যাকলাম ঘোর নিশি। চিয়ারমেনের দুপক্ষির দুই ছেলির মদ্যি ত্যাকুন জমিজমার ভাগাভাগি নি বিবাদ চলচি। বাজ্জি না সেরি ঘরে আলাম। ঠান্ডা বাসাত হচ্ছিল, তাই ঠিকমতন চোখ বন্ধ করার টাইম পালাম না, আরামে তার আগেই ঘুম চলি আসলু। ঘুম ভাঙলু এক্কেবারে বিহানে, চেয়ারম্যান বাড়ির হইচইয়ে। মদ্যি রাতি কী হয়ছে আমার কিচ্ছু মনে নেই, স্যার।’
‘মনে করার চেষ্টা কর। রাতে ফের পায়খানার বেগ উঠল। তুই বদনাটা নিয়ে বাইরে গেলি।’
‘হতি পারে। কেননা, সকালে উঠি দ্যাখলাম প্যাট একদম খালি। এরপর কি করলাম স্যার?’ খগেন জানতে চায়।
খগেনের কাজ ছিল রোজ ঘুম থেকে উঠে চেয়ারম্যানকে একচোট গালিগালাজ করে নেওয়া। এরপর বগলে লাঠি আর কাঁধে ঝোলাটা গুঁজে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যায় যখন ফেরে, তখন আর গালাগালি করে না। হারিয়ে যাওয়া সংসার, জন্ম না-নেওয়া সন্তানের কথা মনে করে কাঁদে। অনেক রাত পর্যন্ত ওর ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে। কিন্তু সকাল হলেই খগেন ফের বদলে যায়।
‘পায়খানা সেরে ঘরে গেলি। হাতের কাছে বঁটিটা ছিল, তুলে নিলি।’ দারোগা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
‘জে, মনে পড়ছে।’ তবে আমার ঘরে বঁটি নেই, হেঁসু হতি পারে।
‘বিবরণে যেহেতু বঁটির কথা আছে, তুই বঁটির কথা বল। খুন যখন করেছিস, তখন বঁটি আর হেঁসুতে কী এসে–যায়! শাস্তি যা হওয়ার তা তো হবেই।’
‘জে, বঁটিই ভালো। এমনিতেও আসচি হাটে একটা বঁটি কিনতাম। হেঁসুতে তরকারি কাটতি কষ্ট হয়।’
‘এরপর তুই বঁটিটা নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলি। মনে পড়ে?’
‘জে, এ রকম একটা খোয়াব আমি দেখছিলাম।’
‘তুই চেয়ারম্যানের ঘরের ভেতর ঢুকে তার নাকে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল ধরে অজ্ঞান করে নিলি। নিলি তো?’
‘জে, নিলাম।’ বলে খগেন একটু থেমে জিজ্ঞাসা করে, ‘ক্লোরোফর্ম কী, স্যার?’
‘অজ্ঞান করতে গেলে লাগে।’ এর বেশি তোকে বুঝতে হবে না।
‘হ, ঠিকই। কম বুইঝি কাজ হলি বেশি বুইঝি লাভ নেই।’
‘এরপর চেয়ারম্যান অজ্ঞান হয়ে গেলে তুই চট করে ছাগল বাঁধার দড়ি দিয়ে তার হাত দুটো বেঁধে দিলি। বুড়ো মানুষ, কোনো ঝুঁকি নিতে না চাওয়াই স্বাভাবিক। ভুল বললাম?’
‘জে না, এই বয়সে আর কুনো কাজেই ঝুঁকি নিয়া ঠিক হবে না।’
‘হাত বাঁধা হলে বঁটিটা দিয়ে গলায় একটা পোঁচ মেরে দিলি; ঠিক কি না।’
‘জে, গাঁয়ির সব মানুষ য্যাকুন বুলচি, আপনিও বুলচেন, ত্যাকুন ভুল হতি পারে না।’
‘তার মানে স্বীকার করে নিচ্ছিস যে চেয়ারম্যানকে তুই মাঝরাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিস?’
‘মেলা দিনের পরিকল্পনা, স্যার।’ খগেন ঠান্ডা গলায় বলে।
দারোগা খগেনকে লকআপের ভেতর ঢোকানোর আগে সহকর্মীকে বলেন জবানবন্দিতে একটা টিপসই দিয়ে নিতে।
‘স্যার, দেখছেনই তো, দুই হাতই কাটা। কনুই-ই নেই তো আঙুল পাব কোথা থেকে!’
‘তাই তো। আচ্ছা, ঢুকিয়ে দে।’ দারোগা বলেন। তাকে খুব খুশিখুশি মনে হয়।
লকআপে নেওয়ার সময় কনস্টেবল একবার জিজ্ঞাসা করে, ‘হাত কাটছে ক্যামনে? চুরি–ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খাইছিলা নাকি?’
খগেন কোনো উত্তর করে না। একবার মনে হলো বলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় খগেনের হাত দুটো কেটে নিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। চেয়ারম্যান তখন যুবক, শক্ত করে খগেনের পা দুটো বেঁধে দিয়েছিল। বলতে গিয়ে মনে হলো, সাজা যা হওয়ার তা তো হবেই!