হঠাৎ করে আমার একটা রোগ হয়ে গেল—নাম মনে থাকে না। নিজের নাম।
সেদিন ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলাম। ম্যানেজার নাম জিজ্ঞেস করলেন। বলতে পারলাম না। আমি হাসি। ম্যানেজারও হাসে। এক গ্লাস পানি খেলাম। তিনি আমাকে বেশ ফানি একটা লোক ভাবলেন। আমার নীরবতা, আমতা আমতা করা বা নিজের নাম বলতে না পারাটাকে আড়াল করার বাড়তি স্মার্টনেস দেখানো…সবকিছু খুব এনজয় করছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটলে তিনি একসময় ধীরস্থির ভাবে বললেন, ‘আপনি কি এভাবেই লোকজনকে ভড়কে দেন?’
‘কীভাবে?’
‘এই যে নিজের নাম বলতে পারছেন না।’
এর আগেও বেশ কয়েকবার এ রকম সমস্যা হয়েছে। একবার ট্রেনে। পাশের সিটে বসেছিলেন মুরুব্বি টাইপের একটা লোক। যাকে পান তাকেই দু–একটা উপদেশ শোনান। টিটিই টিকিট চেক এলে বললেন, ‘আপনাদের চেকিংটা ভালো না। অনেক ফাঁকফোকর আছে। বাথরুমটা ভালোমতো চেক কইরেন। টিকিট না কাটলে ওইখানে গিয়া লুকায়া থাকে অনেকে। আমিও একদিন ছিলাম। হে হে হে।’
তার কথার চাপে আমার মাথা ভনভন করছিল। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাইজানের নাম?’
মুরুব্বি গোছের লোক, নাম বলাটা সাধারণ ভদ্রতা। বলতেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ থেমে গেলাম। নাম মনে আসছে না। হায় হায়, অনেক চেষ্টা করলাম। মোবাইলে গুঁতোগুঁতি করলাম। কারও কোনো মেসেজে নাম মেনশন করা আছে কি না। না নেই। শুধু অফার অফার আর অফারের বার্তা। লোকটা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে চেষ্টা করছিল আমার সমস্যাটা কোথায়।
‘ঠিক আছে, বলতে না চাইলে নাই। অনেকে নিজের নাম বলতে চায় না। বিশেষ করে যাদের নাম খুব খারাপ। আজব এক লোক দেখলাম, যার নাম ইবলিশ। তো সে ক্যামনে কয়, তার নাম ইবলিশ? হে হে হে।’
মাঝেমধ্যে আমার খুব অসহায় লাগতে শুরু করে। যখন নাম মনে করতে পারি না, তখন কাকতালীয়ভাবে এমন ঘটে যে নিজের নাম আঁকা বা লেখা এমন কিছুও খুঁজে পাই না। আশপাশে এমন কাউকেই পাই না, যার কাছে অবলীলায় নিজের নাম জিজ্ঞেস করতে পারি। মাথা টনটন করতে থাকে। ঘুরতে শুরু করে। বমি পায়। এক ভয়ানক অনুভূতি। সমস্যাটা কারও সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। নির্ঘাত পাগল মনে করবে।
গতকাল অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ সমস্যাটা চেপে বসল। নিজের নাম মনে নেই। পকেট হাতড়ে কোনো কার্ড পেলাম না। একটা চায়ের দোকানে গেলাম। দোকানদার মকবুল। পূর্বপরিচিত। ভাবলাম, যাওয়ামাত্র পয়লাই আমার নাম ধরে সালাম দেবে। সালাম যথারীতি দিল, তবে নাম ছাড়া। ‘স্লামালিকুম ভাই।’ শালা, প্রপার নাউন বলতে তোর সমস্যা কোথায়? পরে এক কাপ চা খেতে খেতে অপেক্ষা করলাম, পরিচিত কেউ নিশ্চয়ই আসবে। এসে অবশ্যই আমার নাম ধরে ডেকে দু–একটা কথা হয়তো সৌজন্যবশত জিজ্ঞেস করবে। না, কেউ এল না। যারা এল, তারা আমার নাম ধরে ডাকার মতো কেউ না। পরে বাধ্য হয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘মকবুল, আমার নামটা যেন কী?’ মকবুল তাকিয়ে হাসল। ‘চা ভালো হইছে না? এক চুমুক দিয়াই নিজের নাম ভুইলা গেছেন। হে হে হে।’
মকবুল মজা করে হাসে। তাকে বোঝানোই গেল না, রসিকতা না। সত্যি সত্যি আমার নাম মনে নেই।
ভারাক্রান্ত মনে বাসায় গেলাম। বউ সব সময় ভাববাচ্যে কথা বলে। সুতরাং তার কাছ থেকে নাম শোনার সম্ভাবনা নেই। আর জিজ্ঞেস করলেও উড়িয়ে দেবে। বলবে, ‘নিজের নাম তো তুমি ভুলবাই। নাম মনে রাখার লাইগা বড় কিছু হইতে হয়। নামটা খোদাই কইরা রাখার মতন কিছু হইতে হয়। পাথরে, দেয়ালে না হইলেও মনের ভেতর। কিছু তো হইতে পারলা না।’
এরপর শুরু হবে পুরুষ বা স্বামী হিসেবে আমার ব্যর্থতার খতিয়ান। বউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি পুরো ঘর তছনছ করে খুঁজতে শুরু করলাম, আমার নাম কোথাও না কোথাও তো আছে। কেউ কোনো বই গিফট করলে তো নাম লিখবেই। সে রকম বইও পাওয়া যাচ্ছে না। সব ভাববাচ্যে লেখা। সুহৃদেষু, সুজনেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু—এমন। নাম নেই। বউ রান্নাঘরে কাজ করছিল। চুপি চুপি তার মোবাইলটা হাতে নিলাম। আমার নাম নিশ্চয় সেভ করা আছে। গুঁতোগুঁতি করলাম ভয়ে ভয়ে, দেখলে রক্ষা নাই। ‘ও, নামতে নামতে এতটাই নামছ, বউয়ের মোবাইলে গোয়েন্দাগিরি করতেছ। না? ছি!’ একটা নম্বর সেইভ করা। ‘তুমি’ নম্বর দেখে বুঝলাম। সেটাই আমি। নাম সেভ করার কত যে ধরন—‘তুমি!’ হতাশ হয়ে পায়চারি করতে থাকি। এমন সময় বাড়িওয়ালা আসে। দুই মাসের ভাড়া বাকি। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আমার নামটা একটু বলবেন?’ বাড়িওয়ালা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, যার অর্থ ভান ধরছ, মিয়া! পাগল সাজতেছ? যাতে ভাড়া মওকুফ কইরা দিই? বকেয়া পরিশোধের লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে বাড়িওয়ালা চলে গেল।
কী এক অস্বস্তি। নামটা মনেই আসছিল না।
রাতে বউয়ের পাশে শুয়ে হাঁসফাঁস করি ভেতরে ভেতরে। বউ মোবাইলে একটা রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে ঘুমে ডুবে গেছে। পিনপিনিয়ে বাজছে গান। ‘তোমারেই করিয়াছি, জীবনের ধ্রুবতারা…’
ইউরেকা! ধ্রুব! চেঁচিয়ে উঠলাম। আনন্দে উত্তেজনায় বউকে জাপটে ধরলাম। বউ বিরক্ত হয়ে একটা লাথি দিল। মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেও সমস্যা নেই। আজ মেঝেতেও যদি ঘুমাই ঘুম ভালো হবে। সাউন্ড স্লিপ।
গুনগুনিয়ে গান শুরু করলাম। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা…।’ বউয়ের নামটাও এফিডেভিট করে ‘তারা’ রাখা দরকার। তাহলে সে–ও যদি কোনো দিন তার নাম ভুলে যায়, এই গান বাজালেই চলবে। দুজনে একসঙ্গে নাম মনে করতে পারব। ধ্রুবতারা!
সাইকিয়াটিস্ট দারুণ জিনিস। মনের পাতাল খুঁড়ে ক্লু বের করে।
তার সামনে কিছু লুকাতে নেই। গল্পটা শুরু করলাম:
‘সেই দিন সন্ধ্যা হয়ে আসতেছিল। অফিস একটু দেরিতেই শেষ হইছিল।
রিকশা-টিকশা কিছু পাইতেছিলাম না। হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। মহল্লার গলিগুলা ডেয়ারিং। সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে হয়া যায়। গাড়ি–ঘোড়াও কমে যায়। মফস্সল শহরে এই রকম অলিগলি থাকে।
কিন্তু সেদিন ক্যামন জানি গা ছমছম করছিল। এমন সময় শুরু হইল পিনপিনা বৃষ্টি। দাঁড়াইলাম একটা দোকানের টিনের ছাউনির তলায়। দোকান ছিল বন্ধ। কোনোমতে শাটারের লগে পিঠ ঠেকায়া বৃষ্টির হাত থিকা বাঁচার চেষ্টা। বৃষ্টি থামতেছে না। গলির মুখে হঠাৎ তিন–চাইরটা লোক গালিগালাজ করতে করতে আসে। দেখি, একজনকে তারা টানাহেঁচড়া কইরা আনতেছে। একজন শার্টের কলার ধরছে তো আরেকজন শার্টের হাতা। লোকটা কানতেছিল। আমি ভয়ে চুপচাপ দাঁড়ায়া ছিলাম। ওদের একজনের হাতে একটা লম্বা ছোরা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাইলে ছোরাটা যেন চোখ ঝলসায়া দেয়। লোকটা তাগো পা ধইরা কান্নাকাটি করে। কিন্তু তাগো মন টলে না। ছোরাটা বসায়া দিল লোকটার বুক বরাবর। লোকটা লুটায়া পড়ল। তারা তিনজন দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া তারে দ্যাখে। হঠাৎ একজন আমারে দেখতে পায়। আমি পালানির রাস্তা খুঁজি। পাই না। মূর্তির মতন দাঁড়ায়া থাকি। দুজন আমার দিকে আগায়া আসে। ছোরা মারা লোকটা আমারে ঠেসে ধরে দোকানের শাটারের লগে। আমার দম বন্ধ হয়া আসতে থাকে।
আরেকজন বলে, ‘আমার নাম কী ক তো?’ আমি তারে ভালোই চিনি। মহল্লায় থাকে। মোটরসাইকেলে করে ঘোরে। একবার রিকশায় করে বউয়ের লগে ঘুরতে যাওয়ার সময় বউয়ের শাড়ি চাকায় পেঁচায়া গেলে সে রিকশা থামায়া আঁচল খুইলা দেয়। তখনই তার পরিচয় দিছিল। নাম ফজলু। নাম বলার পর বউয়ের দিকে সে ক্যামন কইরা জানি তাকায়া ছিল। বউ পরে বাসায় ফির্যা বলছিল, লোকটার তাকানো তার ভালো লাগে নাই। আরেক দিন নাকি সে কোনো এক বাহানায় বাসায় আইসা বউয়ের লগে দেখাও কইরা যায়।
সে ধমক দিল, ‘কী রে! আমার নাম ভুইলা গেছস?’
আমি চমকে বললাম, ‘ফজলু! ফজলু ভাই!’
সে খেইপা গেল। গালিগালাজ শুরু করল। ‘এ্যাই শালা। চোপ। আমার কোনো নাম নাই। বুঝছস। আমার কোনো নাম নাই। তুই যারে দেখছস, তার কোনো নাম নাই। কোনো দিন যদি থানা–পুলিশ জিজ্ঞাস করে, কারে দেখছিলি, কী কইবি? কইবি, তার কোনো নাম নাই। মানে আমার কোনো নাম নাই। বুঝছস? কথা খিয়াল রাখিস। নাইলে কইলাম…তোর বউয়ের শাড়ি এরপর থিকা রিকশায় খালি পেঁচাইব আর পেঁচাইব, আর একজন আইসা সেইটা খুইলা দিব আর খুইলা দিব।’
‘এরপর থিকা কী হইল কে জানে। নিজের নাম ভুইলা যাই। হঠাৎ হঠাৎ। কোনোভাবেই আর মনে করতে পারি না।’
আমার গল্প আপাতত শেষ হয়। সাইকিয়াটিস্ট অবাক তাকিয়ে থাকে। আর কী যেন নোট করতে থাকে খাতার পাতায়।
প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
আজ রাতে বোধ হয় বৃষ্টিতে ভেসে যাবে দুনিয়া।
হঠাৎ করেই রাত থেকে ঝুম বৃষ্টি।
বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। দশটা না বাজতেই ওর ঘুম। ঘুমাবেই তো! কত কাজ করে! ঘরের সব কাজ করার পর টুকটাক সেলাইয়ের কাজও করে সে। দু-চারজন কাস্টমারও জুটেছে।
ছোট্ট বারান্দায় বসে আমি আলো-আঁধারির মধ্যে বৃষ্টি দেখি। এর মধ্যে হঠাৎ আবার রোগটা চেপে বসে। নিজের নাম মনে করতে পারি না। অস্থির লাগতে শুরু করে।
ঠিক তখনই সাইকিয়াটিস্টের কথাটা মনে আসে:
‘যদ্দিন পর্যন্ত আপনি পুলিশের কাছে গিয়ে লোকটার নাম বলে দিতে না পেরেছেন, এই রোগ আপনাকে ছাড়বে না। ব্যাপারটার একধরনের ডিপ ইন্টারকানেকশন আছে।’
বিদ্যুৎ চমকায়। যেন আলোর ঝলকানি। কেন যেন ভালো লাগে। মনের ভেতর একটা দৃঢ়তা পাই। কোন ফাঁকে বউ উঠে চলে এসেছে খেয়াল করিনি। হাতে এক কাপ চা। বৃষ্টির রাতে গরম চা। এর চেয়ে ভালো লাগার আর কী হতে পারে। বউ রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়েছে। তার শাড়ির আঁচল উড়ে এসে নাকে–মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সব ঠিক আছে, শুধু নিজের নামটা মনে করতে পারছি না।
‘সেদিন খুব খারাপ ব্যবহার করছি। সরি ধ্রুব!’
ওহ্! ধ্রুব!! চায়ের সঙ্গে নামও ফ্রি! দারুণ ব্যাপার! নাম ফিরে পাওয়ায় বউয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। চায়ে চুমুক দিলাম। চিনি একটু কম। তা–ও খুব মধুর।