Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-03%2F92015489-df68-4e43-b918-642b211db240%2Fajgubi.gif?w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

আজগুবি

সুমন্ত আসলাম



‘সোজা একটা কোপ দিই মানুষটার ঘাড়ে। পড়ে যান। পা দিয়ে চেপে ধরি তাকে মাটির সঙ্গে, ছুরিটা গলায় চালিয়ে দিই আবার। শরীর থেকে আলাদা করে ফেলি পুরো মাথাটা। ঘটনাটা ঘটে ঠিক তখনই।’ 

সক্রেটিসের মতো ঈষৎ বের হওয়া চোখে হারুন সাহেব সামনে তাকালেন। হাতের সিগারেটটা ঠুকতে লাগলেন বাঁ হাতে চেপে ধরা দেশলাইয়ে। ওপরের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ নেমে আসা গোঁফগুলোতেও হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। কিন্তু হাতটা ওখানেই রইল, গোঁফ ঘেঁষে, ঠোঁট ছুঁয়ে। মুখে ঢুকে যাওয়া কোনো একটা কুটো ফেলে দিলেন থু করে, ‘তারপর মাথাটা কথা বলতে শুরু করল।’

‘জি। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলেনি। কিছুক্ষণ ওটা মাটিতে পড়ে ছিল। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল কাটা জায়গাটা থেকে। সাদা শ্বাসনালিটাও কাঁপছিল তিরতির করে। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায় মাথাটা। হেঁটে আসার মতো মাটি ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসে আমার দিকে। কাতর গলায় বলে, “এভাবে তো আমাকে মারার কথা ছিল না, আঙ্কেল!”’

‘কথা বলার সময় কাটা মাথাটার চোখ দুটো কি খোলা ছিল?’

‘খোলা তো ছিলই, পিটপিটও করছিল ও দুটো।’

হারুন সাহেব হাতের সিগারেটটা মুখে ঢোকালেন। দুই ঠোঁটে চেপে স্থির হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সামনে বসা মানুষটার দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলেন—সালেকীন রাজ, বয়স ৪২, স্বাস্থ্য ভালো, উচ্চতা মাঝারি, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সাপ্লাইয়ার।

‘রাজ সাহেব।’ সিগারেটে আগুন ধরালেন হারুন সাহেব। দুই ঠোঁট কিঞ্চিৎ সরু করে মুখের ধোঁয়াগুলো ছাড়লেন বাতাসে। তাকিয়ে রইলেন গোল গোল রূপ নেওয়া ধোঁয়াতে, কিন্তু তার মনোযোগ আর চোখের স্থিরতা দেখে মনে হলো, ওগুলো ধোঁয়া না, তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া অনেক দিনের আপনজন।

‘এই খুনের আগে আপনি আর কোনো খুন করেছেন কখনো?’

‘এই খুনের আগে মানে!’ ভ্রু দুটো সংকুচিত করে ফেললেন সালেকীন রাজ, ‘আপনি এটাকে খুন ভাবছেন, স্যার?’

‘আপনার কি মনে হয়, এটা খুন না?’

‘না, এটা খুন না।’

‘তাহলে?’

‘আপনার “তাহলে”র উত্তরটা আমি দিতে চাচ্ছি না, স্যার। কারণ, আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাতের মতো এক হাজার একটা যুক্তি দেখালেও আপনি বা আপনারা আমার কোনো যুক্তিই আমলে নেবেন না। যদিও আপাতদৃষ্টে এটা খুনই।’

কিঞ্চিৎ নেমে আসা গোঁফগুলোতে হাত বোলালেন হারুন সাহেব, ‘এই মুহূর্তে আপনার কোনো ইচ্ছে আছে?’ 

‘ইচ্ছে বলুন আর সাধ বলুন—একটাই। তিন দিন ধরে আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে, হাত দুটোও বাঁধা। চোখ দুটো খুলে দিলে ভালো হয়। দুনিয়াটা দেখে যেতে চাই শেষবারের মতো।’

‘শেষবারের মতো কেন!’

দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হলো সালেকীন রাজের। কিন্তু একটু গভীরভাবে তাকালেই বোঝা যেত, ওই হাসিতে ক্লেদ আছে, তাচ্ছিল্য আছে, অবজ্ঞাও আছে, জীবনকে চরমভাবে উপেক্ষা করার এক শক্তি আছে।

‘আর কোনো ইচ্ছে?’

‘জি।’ সমাপ্ত-অসমাপ্তের মাঝামাঝিতে থেমে রইলেন সালেকীন রাজ। একধরনের আড়ষ্টতা, কিছুটা দ্বিধাও দেখা গেল গলায়, সম্ভবত অবয়বেও। জড়বস্তুর মতো মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটা তেমন নড়ে না উঠলেও একধরনের চঞ্চলতা দেখা গেল ভঙ্গিতে, ‘আমার পিঠটা আমি একটু দেখতে চাই।’

‘পিঠ দেখে কী হবে!’

‘দিয়োগো আলভেসকে অবশ্য আপনি চিনবেন না। কারণ, তিনি বাংলাদেশের কেউ নন, পর্তুগালের। এক সিরিয়াল খুনি তিনি, উনিশ শতকের। তার কাটা মাথাটি সংরক্ষিত আছে ইউনিভার্সিটি অব লিসবনে। মাথাটি রেখে দেওয়ার কারণ কী জানেন?’

‘কী?’

‘অপরাধীর মন নিয়ে গবেষণা করা।’ সালেকীন রাজ হাসার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তার দুই ঠোঁটের বাঁ পাশের সংযোগস্থলে রক্তের ধারাটি শুকিয়ে এলেও ক্ষতটা চকচক করছে এখনো। ভাগ্যিস, মাথা কিছুটা সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন, না হলে হারুন সাহেবের উল্টো হাতের আংটিটা সরাসরি আঘাত করতে পারত তার চোখে।

‘আপনার পিঠের সঙ্গে ওই খুনির মাথার সম্পর্ক কী?’

‘রিমান্ডের চার দিন হলো আজ, সম্ভবত শেষ দিন। গত চার দিনে আমার পিঠে যে দাগগুলো পড়েছে, সেটা সংরক্ষণ করতে বলব আপনাদের। আমি মারা যাওয়ার পর চামড়াটা ছাড়িয়ে নেবেন। এখন অনেক প্রযুক্তি এসেছে মানুষের শরীর সংরক্ষণের। চামড়াটাও সংরক্ষণ করবেন। এরপর যারা যারা আসবেন—।’ সালেকীন রাজ মাথা তুললেন, সামনের চেয়ারে বসা হারুন সাহেবকে দেখতে মেঝে থেকে যতটুকু উঁচু করা দরকার, করলেন, ‘মানে যাদের যাদের ধরে নিয়ে আসবেন, তাদের দেখাবেন, আশা রাখি তিন–চার দিন লাগবে না, এক বা দুই দিনেই রিমান্ড শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য আমার মাথাটা, বিশেষ করে মাথার সামনের দিকটা, ঠোঁট-মুখ-কপাল-চোখ দুটো সংরক্ষণ করলে ভালো হতো। কিন্তু আমি তা চাচ্ছি না, এই না চাওয়ার বড় একটা কারণ আছে। তাই পিঠের চামড়াটার জন্য সুপারিশ করছি।’   

‘মানুষটাকে মারলেন কেন আপনি?’ হারুন সাহেবের গলাটা এবার বেশ ঠান্ডা।

‘মারার কোনো রকম ইচ্ছে আমার ছিল না। প্রতি রাতে আমার মেয়েটা এত ডিস্ট্রার্ব করত, তাকে না মারার কোনো উপায় ছিল না।’ চেহারাটা কিছু কঠিন করে ফেললেন সালেকীন রাজ, ‘মেয়েটা আমার মারা গিয়েছিল। মৃত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে মেরেছি আমি, বলতে পারেন মারতে বাধ্য হয়েছি।’

‘তার মানে আপনার যে মেয়ে প্রতি রাতে আপনাকে ডিস্ট্রার্ব করত, সে মৃত ছিল!’

‘জি।’

‘একজন মৃত মানুষ আপনাকে ডিস্ট্রার্ব করত!’

‘জি।’

‘কীভাবে?’

মেরুদণ্ড সোজা করে বসার চেষ্টা করলেন সালেকীন রাজ। পেছন দিকে বাঁধা হাত নিয়ে অনেকটা কুঁজো হয়ে বসেছিলেন এতক্ষণ। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘স্যার, একটা অনুরোধ করব?’

‘আজ আপনার সব অনুরোধ রক্ষা করা হবে।’ সিগারেটে আরও একটা টান দিলেন হারুন সাহেব, ‘বলুন।’

‘আমার ডান গালটা প্রচণ্ড চুলকাচ্ছে। বেয়াদবি নেবেন না, কেউ যদি একটু চুলকিয়ে দিত।’ 

চেয়ারে পিঠটা ঠেসে দিলেন হারুন সাহেব। দুই আঙুলের মাঝখানে সিগারেটটা জ্বলছে, লম্বা হচ্ছে ছাই, কিন্তু তিনি স্থির, শক্ত চোয়াল, দৃষ্টিও কেমন কঠিন হয়ে গেল তাঁর।

‘থাক স্যার, লাগবে না। চুলকানিটা থেমে গেছে।’

‘আপনার মেয়ের কথা বলছিলেন আপনি।’

‘জি স্যার।’ লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লেন সালেকীন রাজ, ‘রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমাই আমি। মাসখানেক আগে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখি, মেয়েটা বসে আছে। ভয় আর আতঙ্ক একসঙ্গে ভর করে আমার ওপর। কিন্তু আমি কোনো শব্দ করতে পারি না। আমার এ অসহায়ত্ব দেখে মেয়েটা মুচকি একটা হাসি দেয়। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলে, “বাবা, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম, সরি।”’

‘কত দিন এভাবে এসেছে সে?’

‘পাঁচ দিন, না না, ছয় দিন। সে এসে কিছুই বলে না, আমার পাশে বসে। আমার ভাবলেশহীনতা দেখে, অসহায়ত্ব দেখে, তারপর মুচকি একটা হাসি দেয়, ম্লান হাসি। শেষে কাতর গলায় বলে, “বাবা, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম, সরি।”’

‘তারপর?’

‘হঠাৎ একদিন আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। মেয়েটা এভাবে মুচকি হাসে কেন, যে হাসিতে বেদনা আছে, বাবার প্রতি করুণা আছে! আমার মাথার ভেতরটা কিলবিল করে ওঠে। কিছুটা অপমানিতও বোধ করি। সদ্য পনেরো পেরোনো আমার মেয়েটা; নির্দ্বিধায়, ভয়হীন মনে, মুক্ত পায়ে স্কুলে যেতে পারত না। তবু স্কুলে যেত, বাসায় ফিরত। কিন্তু ফুটফুটে মেয়ের মুখটা থাকত শুকনো, আড়ষ্ট থাকত সে, কুঁকড়ে থাকত সব সময়। পরে একদিন ওই ছেলেটা আমার মেয়ের হাত টেনে ধরে।’

‘তারপর?’ 

‘মেয়ে বাসায় এসে সেই যে ঘরে ঢুকল, আর বের হলো না। শেষে দরজা ভেঙে দেখি, ফ্যানের সাথে নিজের ওড়নায় ঝুলছে সে। তার তিন দিন পরেই ছেলেটার গলা আমি কেটে ফেলি। এখন নতুন আরেকটা সমস্যা শুরু হয়েছে, স্যার।’

‘কী?’

‘মেয়েটা এখনো দু-এক রাত পরপর আমার কাছে আসে, কিন্তু একা আসে না, ওই ছেলেটার কাটা মাথাটা হাতে নিয়ে আসে। এখন আর তার মুখে মুচকি হাসি দেখি না, প্রফুল্ল একটা হাসি দেয় সে। তার হাসি দেখে মনটা ভরে যায়।’ 

সালেকীন রাজের চেহারাটাও বেশ সতেজ দেখাচ্ছে এখন, ‘গত সপ্তাহে ওই মাথাই আপনারা আমার ডিপ ফ্রিজে পেয়েছেন। মেয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল কদিন আগে। যাওয়ার সময় বলল, “বাবা, আজ আর মাথাটা বয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। রেখে দাও। আবার যখন আসব, নিয়ে যাব। ও চলে যাওয়ার পর ওটা আমি ডিপ ফ্রিজে রেখে দিই।”’

একঝটকায় উঠে দাঁড়ান হারুন সাহেব। কদিন আগে কেনা নতুন জুতাসহ পা–টা একটু উঁচু হয় তাঁর, প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারেন সালেকীন রাজের পাঁজরে। তারপর চিৎকার করে বলেন, ‘কুত্তার বাচ্চা, এসব আজগুবি গল্প কোথায় পাস তুই! কদিন ধরেই এসব আজগুবি কথাবার্তা বলে যাচ্ছিস একনাগাড়ে।’

কায়দা করে সোজা হয়ে বসেন সালেকীন রাজ। ব্যথা সয়ে যাওয়া শরীরে পাঁজরটা কেমন মুচড়ে ওঠে। হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা তাঁর। সামনে দাঁড়ানো গজরাতে থাকা হারুন সাহেবের দিকে অনুমানে তাকান তিনি, ‘এটা–ওটা সাপ্লাই দেওয়া ছোটখাটো এক ঠিকাদার আমি, এই সাধারণ মানুষটার ঘরে একটা কাটা মাথা পেলেন আপনারা, একটা দেশি অস্ত্র পেলেন, সেটার গুলি পেলেন, মাদকও পেলেন। এগুলো আমার ঘরে, অথচ আমি কিছুই জানি না। একটু পর, কিংবা দুই ঘণ্টা পর যখন কোনো ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে দৌড়াতে বলবেন, চোখ বাঁধা, তবু দৌড়াব আমি, পেছন থেকে একটা বা দুটো ধাতব পিণ্ড শরীরে ঢুকে যাবে আমার। পরদিন আপনারা আয়োজন করে বলবেন, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে সন্ত্রাসী সালেকীন রাজ।’ নির্ভার চিত্তে সালেকীন রাজ আরেকটু হাসেন, ‘এবার বলুন তো স্যার, আমি এতক্ষণ যা বললাম, তা আজগুবি; না আপনারা যা বলেন তা আজগুবি?’

মুখের কুটো ফেলার মতো আরও একবার থু করলেন হারুন সাহেব। সালেকীন রাজ কুঁজো হয়ে গেলেন এবার, নত হয়ে গেল তার মাথা, ‘স্যার, একটা অনুরোধ ছিল। নিয়তিমাখা এ পরিণতির পর নিথর দেহটা আমার পরিবারকে ফেরত দেবেন না, প্লিজ। ফেলে দেবেন কোনো নদীতে বা পুঁতে ফেলবেন বালুতে। ৯ বছরের আরও একটা মেয়ে আছে আমার। ও জানবে, ওর বাবা কাজে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। কদিন পর ওকে জানানো হবে, গুম হয়েছে ওর বাবা। তারপর প্রতিবছর সবাইকে জানিয়ে আড়ম্বর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের মানুষদের নিয়ে। আমার মেয়েটা ওই অনুষ্ঠানে তার দুচোখ ভিজিয়ে আশাবাদী হয়ে বলবে, “আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই, আপনারা আমার বাবাকে ফেরত দিন।” তার এই আশাবাদী চেহারা আর আজগুবি আবদারে সবার চোখ ভিজে যাবে। তারও পর সবাই চোখ মুছতে মুছতে যার যার বাড়ি ফিরবে। কেউ কেউ ১০ টাকার বাদাম কিনে যেতে যেতে খেতে খেতে বলবে, ‘পুরাই ভেজালে ভরে গেছে দেশটা, তিনটার মধ্যে দুইটা বাদামই পচা!’